মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কমর্ই গড়বে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব

আগামী ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস, এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য কমের্ গড়া ভবিষ্যৎ, কমর্ই গড়বে ২০৩০ সালে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব। এই উপলক্ষে বিশেষ ফিচার লিখেছেন- কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ
নতুনধারা
  ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

বিশ্ব আজ বিজ্ঞাননিভর্র। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানান সুবিধা গ্রহণ করে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে। ফলে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূণর্তা অজর্ন করেছে। স্বাধীনতা পরবতীর্ সময়ে দেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭ কোটি ১২ লাখ। আর চালের উৎপাদন ছিল মাত্র এক কোটি টন। স্বাধীনতা পরবতীর্ সময়ে আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ অথচ গত সাড়ে চার দশকের বেশি সময়ে জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি। প্রতি বছর ১% হারে আবাদি জমি হ্রাস সত্তে¡ও জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চালের উৎপাদন বতর্মানে ৩ কোটি ৬২ লাখ টন। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুথর্ এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণপূবর্ এশিয়ায় প্রথম। এই সাফল্য এসেছে হাইব্রিড ও উচ্চফলনশীল আধুনিক ধানের জাত ও আনুষঙ্গিক লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে। বাংলাদেশের মানুষ আগে অনাহারে অধার্হারে থাকত। এখন মানুষের ক্ষুধা মুক্ত হয়েছে। মানুষ অপুষ্টিতে ভুগত, এখন কমেছে। জমি কমছে মানুষ বাড়ছে। তবুও কৃষি উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ অধার্হারে অনাহারে আছে। তাদের ক্ষুধামুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশকে ক্ষুধামুক্ত করে বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ কাজ করছে। দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূণর্। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি করছে।

বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ বিরাট ভ‚মিকা রাখছে। এবার দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন। আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর আলু রপ্তানি হয়েছে ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সবজি উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ তৃতীয়। বছরে মোট সবজি উৎপাদন ১ কোটি ৬০ লাখ ৪২ হাজার মেট্রিক টন। প্রতিবছরই সবজির উৎপাদন বাড়ছে ৮-৯ শতাংশ ও ভুট্টার ১২-১৩ শতাংশ। খাদ্যোৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণেরও বেশি। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুথর্। মাছ রপ্তানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলেছে, ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অজর্ন করবে তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী পঁাচ বছরে চাল, গম ও ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ৪৮ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন। শাক-সবজির উৎপাদন বেড়েছে ৩২ লাখ ৯৭ হাজার মেট্রিক টন। তেল, ডাল ও মসলাজাতীয় ফসলের উৎপাদন বেড়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ৫০ হাজার, ২ লাখ ৪ হাজার ও ১ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। দুই যুগ আগেও দেশের অধের্ক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বতর্মানে দেশে বছরে গড়ে দুটির বেশি ফসল চাষ হচ্ছে। চারটি ফসল চাষ করার গবেষণা শেষ করে প্রক্রিয়া চলছে। পঁাচ ফসল মডেল চাষ করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তি হয়েছে। ফসলের প্রতিক‚লতা সহিষ্ণু ও উচ্চফলনশীল নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে ১৭৯টি দেশে। এ পযর্ন্ত ধানের ১০৭টি ও বিভিন্ন ফসলের প্রায় পঁাচ শতাধিক উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ ছাড়া ছয় শতাধিক বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। মাছ, গবাদিপশু, হঁাস-মুরগির ক্ষেত্রেও উন্নত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। দেশে এখন কৃষিতে কৃত্রিম উপগ্রহ, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, ওয়েবসাইটসহ বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। ১৯৭১ সালে আবাদি জমির ১৫ শতাংশ সেচের আওতায় ছিল এখন তা বেড়ে ৬১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এগুলো বিশ্বে ক্ষুধামুক্ত তথা খাদ্য নিরাপত্তা অজের্ন ভ‚মিকা রাখছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, খাদ্য নিরাপত্তা হচ্ছেÑ সব মানুষের কমর্ক্ষম ও সুস্থ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য চাহিদার বিপরীতে পছন্দমতো পযার্প্ত নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্যপ্রাপ্তির বাস্তব ও আথির্ক ক্ষমতা থাকা। খাদ্য নিরাপত্তা অজির্ত হয়েছে কিনা বোঝার উপায় হচ্ছেÑ জাতীয়পযাের্য় পযার্প্ত খাদ্য সরবরাহ থাকবে, সময় ও অঞ্চলভেদে সরবরাহ স্থিতিশীল থাকবে, সবাই খাদ্য ক্রয় বা সংগ্রহ করতে পারবে, পুষ্টিকর ও নিরাপদ স্বাস্থ্যকর খাদ্য সহজলভ্য থাকবে। অথার্ৎ খাদ্য নিরাপত্তার মূল বিষয় তিনটি যেমনÑ খাদ্যের সহজ প্রাপ্যতা, খাদ্যের লভ্যতা ও স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাদ্য। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অজের্নর জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অজের্ন করণীয়গুলো হচ্ছেÑ ফসলের উৎপাদন খরচ কমানো, খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধি, আবাদি জমি বাড়ানো, প্রাকৃতিক দুযোর্গ সহনশীল জাত উদ্ভাবন, জলবায়ু পরিবতর্ন উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন, আন্তঃফসল, মিশ্রফসল, রিলেফসল, রেটুন ফসল চাষ, সেচের আওতা বৃদ্ধি করা, উফশী ও হাইব্রিড ফসল চাষ, শস্য বহুমুখীকরণ, জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনা, ধানক্ষেতে ও পুকুরে মাছ-মুরগি-হঁাসের সমন্বিত চাষ করা, রোগ ও পোকা দমনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার. সহজ শতের্ ঋণ দেয়া, পশুপাখির জন্য জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত, ভতুির্ক বাড়ানো সংরক্ষণাগার বাড়ানো, কৃষি উপকরণ সরবরাহ, শস্যবীমা চালু করা ইত্যাদি।

পৃথিবী এখন সবচেয়ে ভয়াবহ খাদ্য সংকটে আছে। কারণ, পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে, খাদ্যোৎপাদন বাড়ছে গাণিতিক হারে। অন্যদিকে, আবাদি জমি কমছে, জলবায়ু পরিবতর্ন, প্রাকৃতিক দুযোর্গ, কৃষি উপকরণ সংকটসহ হাজারো সমস্যার জন্য কৃষি উৎপাদন কাক্সিক্ষত পযাের্য় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এর হিসাবে পৃথিবীতে বতর্মানে ২২টি দেশ বেশি খাদ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির সূচকের তালিকায় ১৯৬টি দেশ রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭, পাকিস্তানের ২২, ভারতের ৫১ ও চীন ১২৫তম ঝুঁকিপূণর্ দেশ। বিশ্বে ক্ষুধা নামক নীরব ঘাতকের হাতে প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার লোক মারা যাচ্ছে। ৮৫২ মিলিয়ন লোক ক্ষুধাতর্ থাকে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য কমর্সূচি, ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তজাির্তক কৃষি উন্নয়ন তহবিল বলেছে, জলবায়ু পরিবতর্ন, বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুযোর্গ ইত্যাদি কারণে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধাতর্ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৭ সালের বিশ্বের ৮২ কোটি ১০ লাখ লোক ছিল অপুষ্টির শিকার। অথার্ৎ বিশ্বের প্রতি ৯ জন মানুষের ১ জন পুষ্টি পায় না। পঁাচ বছর থেকে কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ১৫ কোটির দৈহিক স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে না পুষ্টিহীনতায়। এই সংখ্যা বিশ্বের মোট শিশুর ২২ শতাংশ।

একমাত্র কৃষির মাধ্যমেই বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করা সম্ভব। কারণ সবাই কৃষির ওপর নিভর্রশীল। কৃষির সব পণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও ক্রয়-বিক্রয় করে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। বাংলাদেশ বিভিন্ন ফসল, শাক-সবজি, ফল, মসলা, মাশরুম, বীজ উৎপাদন, গরু মোটাতাজাকরণ, দুগ্ধশিল্প, ছাগল পালন, মহিষ পালন, ব্রয়লার-লেয়ার পালন, কোয়েল, টাকির্, তিতির, কবুতর, হঁাস পালন, মাছ চাষ, চিংড়ি চাষ, পোনা উৎপাদন, সামাজিক বনায়ন, ফুল চাষ, জৈবসার তৈরি, বায়োগ্যাস তৈরিসহ ক্ষুধামুক্তির বিভিন্ন উপকরণ নিরলসভাবে গবেষণা ও উৎপাদন করে যাচ্ছে।

আশা করছি, দেশের কৃষক, কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষি মিডিয়া, কৃষিকমীর্, কৃষি সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান ও কৃষি ব্যক্তিত্বসহ সবাই মিলে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়বে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক,

শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভ‚ঞাপুর, টাঙ্গাইল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<17326 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1