বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রæত বিকশিত হচ্ছে টাকির্ খামার

বাংলাদেশের অনুক‚ল আবহাওয়া ও পরিবেশে পশুপাখি পালন অন্যান্য দেশের তুলনায় সহজ। টাকির্ও সেরকম একটি সহনশীল পাখির জাত, যারা যে কোনো পরিবেশ দ্রæত মানিয়ে নিতে পারে। টাকির্ পাখির খাদ্য সবুজ ঘাস, শাক, লতাপাতা যা বাংলাদেশে সহজলভ্য। এই সুবাদে দেশে গড়ে উঠতে পারে অসংখ্য ছোট-বড় টাকির্র খামার। আশার খবর হচ্ছে- টাকির্ পালনে তরুণ সমাজে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করা গেছে। তারই প্রতিফলন হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশে ব্যক্তি উদ্যোগে তরুণরা ছোট-মাঝারি খামারে টাকির্ পালন করছেন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন
এস এম মুকুল
  ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০
কম সময়ে অধিক মুনাফা অজের্নর সম্ভাবনা থাকায় বাংলাদেশেও দ্রæত বিকশিত হচ্ছে টাকির্ পালন ছবি : ইন্টারনেট

উৎপাদন ব্যয় কম এবং স্বল্প বিনিয়োগে কম সময়ে অধিক মুনাফা অজের্নর সম্ভাবনা থাকায় বাংলাদেশেও দ্রæত বিকশিত হচ্ছে টাকির্ পালন। মুরগির মতো দেখতে কিন্তু আকৃতিতে অনেক বড় গৃহপালিত পাখিটির নাম টাকির্। মেলিয়াগ্রিস পরিবারের এক ধরনের বড় আকৃতির পাখি এটি। গৃহপালিত টাকির্ও মূলত এ প্রজাতিরই। বাচ্চা অবস্থায় এগুলো দেখতে অনেকটাই মুরগির বাচ্চার মতো। দুইভাবে টাকির্ পালন করা যায়- ১. মুক্তচারণ পালন পদ্ধতি ও ২. নিবিড় পালন পদ্ধতি।

আত্মকমর্সংস্থানে নতুন আশাবাদ

অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারের ফলে শিক্ষিত তরুণরা টাকির্ পালনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বিচ্ছিন্নভাবে বিকশিত খামারিরা টাকির্র মাংসের বাজার সম্প্রসারণে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন এই শিল্প সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে বেকারত্ব দূরীকরণ এবং দারিদ্র্য বিমোচন হওয়ার পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় জোরালো অবস্থান করে নেবে টাকির্র মাংস। ঢাকার সাভার, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নওগঁা, খুলনা, চট্টগ্রাম, যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, ফেনীসহ বিভিন্ন জেলায় ছোট ছোট খামারের পাশাপাশি বড় খামারগুলোতে সফলভাবে টাকির্ লালন-পালন করছেন খামারিরা। খামারিদের সফলতা দেখে নতুন নতুন অনেক উদ্যোক্তা এ নিয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। এতে বহু লোকের কমর্সংস্থানও হচ্ছে। জানা গেছে, টাকির্র জন্য কৃত্রিম খাবারের প্রয়োজন নেই। এ কারণে টাকির্র খাবারের ব্যয়ও খুবই কম। সাধারণ প্রাকৃতিক সবুজ ঘাস ও লতাপাতা এবং শাকসবজি টাকির্র পছন্দের খাবার। এ ছাড়া দানাদার খাবার রাখতে হবে। দেশীয় মুরগির মতো ঘরেও টাকির্ লালন-পালন করা যায়। পুষ্টিকর ও সুস্বাদু হওয়ায় পোল্ট্রির পাশাপাশি টাকির্র মাংসও খাদ্য তালিকায় আদশর্ মাংস হিসেবে ঠঁাই করে নিতে পারলে এর বাজার সম্ভাবনা দ্রæত বাড়বে।

গবেষণায় দেখা গেছে, টাকির্র মাংসে প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ২৪-২৫ ভাগ। অন্য প্রজাতির মুরগির মাংসে প্রোটিন ২২ ভাগ এবং গরুর মাংসে ২০ ভাগ। অন্যদিকে খাসির মাংসে কোলেস্টেরল রয়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। গরুর মাংসে শতকরা ২৪ ভাগ। মুরগির মাংসে ৫ ভাগ। টাকির্র মাংসে কোলেস্টেরল শূন্য ভাগ। টাকির্র খামার সম্প্রসারণে সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগের উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা না থাকলেও টাকির্ খামারি ও আগ্রহীদের ব্যাপক তৎপরতার কারণে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে টাকির্ পালন। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে এখন দরকার সরকারের প্রণোদনা।

দেশি মুরগির মতো পালন করা যায়

টাকির্ পালনে লাভ বেশি। ঝামেলাহীনভাবে দেশি মুরগির মতো পালন করা যায়। একটি ছাগলের তুলনায় একটি টাকির্ থেকে বেশি মাংস পাওয়া সম্ভব। টাকির্র মাংস সুস্বাদু এবং মাংস উৎপাদন ক্ষমতাও ব্যাপক। এক বছরেই একটি টাকির্র ওজন হয় ১২-১৪ কেজি। আবার অন্যান্য পাখির তুলনায় টাকির্র রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। ব্রয়লার মুরগির চেয়েও অনেক দ্রæত বাড়ে। এরা দানাদার খাদ্যের পাশাপাশি শাক, ঘাস, লতাপাতা খেতেও পছন্দ করে। তাই তুলনামূলক টাকির্ পালনে খরচ বেশ কম। কারণ গৃহপালিত মুরগির মতোই মুক্ত অবস্থায় টাকির্ পালন করা যায়। আর আমাদের দেশে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে ঘাস আর লতাপাতার অভাব নেই। টাকির্ মুরগি মাত্র ৬ মাসে ডিম দেয়। ডিমের আকার আমাদের দেশের হঁাসের ডিমের আকৃতির মতো হয়ে থাকে। ৬০-৭০ শতাংশ টাকির্ মুরগি বিকালে ডিম দেয়। টাকির্র একটি ডিম বিক্রি হয় ২০০ টাকায়। ডিম থেকে বের হওয়ার পরই টাকির্র বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে ৬০০-৭০০ টাকায়। দুই সপ্তাহের বাচ্চার দাম ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা। দুই মাসে প্রতিটি টাকির্ বিক্রি করা যায় ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকায়। তিন মাস বয়সী টাকির্ বিক্রি করা যায় সাড়ে তিন হাজার টাকায়। ডিম দেয়ার সময় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকায় প্রতিটি টাকির্ বিক্রি হয়।

জনপ্রিয় হচ্ছে টাকির্র মাংস

জানা গেছে, পোল্ট্রির ১১টি প্রজাতির মধ্যে টাকির্ও একটি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টাকির্র মাংস বেশ জনপ্রিয় ও দামি খাদ্য। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই টাকির্ গৃহপালিত পাখি হিসেবে পালন করা। তবে প্রথম গৃহে টাকির্ পালন শুরু হয় উত্তর আমেরিকায়। পরে ১৫৫০ সালে ইউলিয়াম স্টিকলেন্ট নামে এক ইংরেজ নাবিক প্রথম তুরস্ক থেকে এই জাতের মুরগি মধ্য ইউরোপে নিয়ে আসেন। ফলে তুরস্কের নাম অনুসারে এ পাখিটির নামকরণ করা হয় টাকির্। ক্রমান্বয়ে পাখিটি ইউরোপসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। টাকির্ পালন বেশি জনপ্রিয় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জামাির্ন, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড ও ব্রাজিলে। পাখির মাংস হিসেবে টাকির্র মাংস মজাদার এবং কম চবির্যুক্ত, সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। সারা বিশ্বে এখন টাকির্র মাংস বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশে টাকির্র মাংস এখনো জনপ্রিয়তা পায়নি। অনেকে ধারণা করছেন, পোল্ট্রির পাশাপাশি টাকির্র মাংস দেশে আমিষের চাহিদা পূরণে ভ‚মিকা রাখতে পারে। আবার গরু বা খাসির মাংসের বিকল্প হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জামাির্ন, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড ও ব্রাজিলের জনগণের কাছে টাকির্র মাংস বেশি জনপ্রিয়। জানা গেছে, ব্রাজিল ২০১৫ সালে ১ লাখ ৩২ হাজার ৯০০ টন টাকির্র মাংস রপ্তানি করে।

টাকির্ পাখির খাবার

বন্য টাকির্ সাধারণত বনভ‚মিতে পানির কাছাকাছি এলাকায় থাকতেই বেশি পছন্দ করে। ফসলের বীজ, পোকামাকড় এবং মাঝে মাঝে ব্যাঙ কিংবা টিকটিকি খেয়েও এরা জীবনধারণ করে। অন্যান্য পাখির তুলনায় টাকির্র জন্য বেশি ভিটামিন, প্রোটিন, আমিষ, মিনারেলস দিতে হয়। মাটিতে খাবার সরবরাহ করা যাবে না। সবসময় পরিষ্কার পানি দিতে হবে। খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গৃহপালিত বা খামারে যারা টাকির্ পালন করেন, তারা মোট খাবারের ৫০ ভাগ সবুজ ঘাস, শাক (পালং, সরিষা, কলমি, হেলেঞ্চা, সবুজ ডঁাটা, কচুরিপানা দিতে পারেন)। তবে শাক অবশ্যই কীটনাশকমুক্ত হওয়া আবশ্যক। একটি আদশর্ খাদ্য তালিকা দেয়া হলো : ধান ২০ শতাংশ, গম ২০ শতাংশ, ভুট্টা ২৫ শতাংশ, সয়াবিন মিল ১০ শতাংশ, ঘাসের বীজ ৮ শতাংশ, সূযর্মুখী বীজ ১০ শতাংশ, ঝিনুক গুঁড়া ৭ শতাংশ, মোট ১০০ শতাংশ। নিবিড় পদ্ধতিতে ড্রাই ম্যাশ হিসেবে মোট খাদ্যের ৫০ শতাংশ পযর্ন্ত সবুজ খাবার দেয়া যায়। সব বয়সের টাকির্র জন্য টাটকা লুসানর্ প্রথম শ্রেণির সবুজ খাদ্য।

সহযোগিতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক

বাংলাদেশে টাকির্ পালনে আগ্রহীদের জন্য সুখবর দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেশ লাভজনক এ পাখি পালনের জন্য আগ্রহীদের এখন থেকে ঋণ দেয়া হবে। খামারিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি ও পল্লীঋণের নতুন নীতিমালায় এ পাখি পালনে ঋণ দেয়ার বিষয়টি অন্তভুর্ক্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালাটি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, টাকির্ পালনে উন্নত অবকাঠামো দরকার হয় না। তুলনামূলক খরচও কম। বতর্মানে বাণিজ্যিকভাবে খামার করে টাকির্ পালনে লাভবান হচ্ছেন খামারিরা। এটি মাংসের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি কমর্সংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের অথর্নীতিতে ভ‚মিকা রাখছে। তাই এ খাতে ঋণ সহায়তা দেয়া যেতে পারে।

লেখক : কৃষি ও অথর্নীতি বিশ্লেষক ৎিরঃবঃড়সঁশঁষ৩৬@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<13724 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1