শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পরীর সাথে মেঘের দেশে

আরাফাত শাহীন
  ০১ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

লিমনের মনটা আজ বড্ড খারাপ। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতেই আম্মুর সে কী বকুনি! আব্বু অবশ্য বাড়িতে ছিলেন না। আব্বু বাড়িতে থাকলে কি আর আম্মু এমন করে বকা দিতে পারতেন! লিমনের স্কুলে আজ ক্লাস ফোরের বাষির্ক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। লিমন তৃতীয় হয়েছে। ফাস্টর্ বয়ের থেকে চার আর সেকেন্ড বয়ের থেকে এক নম্বর কম পেয়েছে। এর আগে লিমনের রোল নম্বর ছিল সাত। সাত থেকে এক লাফে তিনে উঠে এসেছে। তারপরও আম্মু খুশি হতে পারেননি। তিনি চেয়েছিলেন লিমন এবার ফাস্টর্ হোক। কিন্তু একবারেই কি আর হিরো হওয়া সম্ভব! লিমন নিজেও কি আর পরিশ্রম কম করেছে! রাতদিন খেয়ে না-খেয়ে পড়েছে। ওর আম্মুই অবশ্য ওকে পড়তে বাধ্য করেছেন। সারাদিন ঘরে বই নিয়ে বসে থাকতে একদম ই‘ছা করে না। ও তো চায় পাড়ার সব ছেলেমেয়ের সঙ্গে মাঠে গিয়ে হৈ-হুল্লোড় করতে। মাঝেমধ্যে লিমনের ই‘ছা হয় মায়ের হাত থেকে পালিয়ে দূরে কোনো জঙ্গলে গিয়ে একা একা বাস করতে। এ ই‘ছাটার কথা অবশ্য আম্মু জানেন না। জানলে মেরে একেবারে বেহুশ করে ফেলবেন! সন্ধ্যা হতেই লিমন কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ির বাইরে বের হয়ে এলো। কোনোকিছুই ওর ভালো লাগছে না। পৃথিবীটাকে ওর কোনো সরীসৃপের মতো মনে হয়। যেন এক্ষুনি ওকে গিলে খেয়ে ফেলবে! কোনোদিকে না তাকিয়ে ও সোজা পুকুরপাড়ে চলে আসে। পুকুরের উত্তর পাশেই প্রকাÐ একটা শিমুলগাছ। শিমুলগাছে টকটকে লাল রঙের শিমুল ফুল ঝুলে আছে। বাতাসের ঝাপটায় পুকুরের পানিতে টুপ করে দু-একটা ঝরে পড়ছে মাঝেমধ্যেই। লিমন শিমুলগাছটার গোড়ায় এসে বসলো। ওর যখন প্রচÐ মন খারাপ হয় তখনই শিমুলগাছটির গোড়ায় এসে বসে। শিমুলগাছটির সঙ্গে কথা বলে। পৃথিবীতে একমাত্র এই গাছটিকে ওর বড় আপন বলে মনে হয়; মনে হয় একমাত্র বন্ধু। অভ্যাসমতো আজও লিমন গাছের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। নিজেই প্রশ্ন করল আবার নিজেই তার উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। গাছের পক্ষে তো আর মানুষের প্রশ্নের জবাব দেয়া সম্ভব নয়! আজ আর ও উত্তর খেঁাজার ঝামেলার দিকে গেল না। একটার পর একটা প্রশ্ন করেই গেল। ‘আ‘ছা আম্মু শুধু শুধু আমাকে বকা দেয় কেন?’ ‘পৃথিবীতে আমাকে কেউ ভালোবাসে না কেন?’ (এই প্রশ্নটা যথাথর্ নয়। কারণ ওর আব্বু ওকে প্রচÐ রকমের ভালোবাসেন। এটা লিমনও অবশ্য জানে।) ‘সবাই শুধু আমাকে কষ্ট দেয় কেন?’ ‘পড়াশুনাতে ভালো করাটাই কি সব?’ ‘আমার কিছুই ভালো লাগে না। এখন আমি কী করব?’ ‘তুমি এখন আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে।’ স্পষ্ট কণ্ঠস্বর শুনে লিমন চমকে উঠল। তবে কণ্ঠটা ঠিক স্বাভাবিক মানুষের মতো নয়। লিমন এদিক-ওদিক কণ্ঠস্বরের উৎস খুঁজতে শুরু করল। আবছা অন্ধকারে ওর গা ছমছম করে উঠল। হঠাৎ ওকে চমকে দিয়ে ওর সামনে মানুষের মতোই অদ্ভুত একটা প্রাণী এসে হাজির হলো। তবে তাকে স্বাভাবিক মানুষ বলা যাবে না কিছুতেই। এটা অনুমান করতে লিমনের কোনো কষ্ট হলো না যে ইনি একজন নারী। মাথায় জ্বলজ্বল করছে একটি সোনার মুকুট। মাথা থেকে পা পযর্ন্ত ধবধবে সাদা পোশাক। আর ভারি মিষ্টি চেহারা। এতক্ষণ মনে যে ভয় ছিল তা পুরোপুরি উধাও হয়ে গেল। লিমনের দিকে তাকিয়ে আগন্তুক মিটিমিটি হাসছে। লিমন প্রশ্ন করল, ‘অমন করে হাসছো কেন?’ আগন্তুক লিমনের প্রশ্নের কাছ দিয়েও গেল না। বরং লিমনকে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘ভয় পেয়েছো নাকি?’ ‘একদমই না। কে তুমি?’ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আগন্তুক মিটিমিটি হাসল। লিমন আবার প্রশ্ন করল, ‘আমার প্রশ্নের জবাব দি‘েছা না কেন? তুমি কে?’ ‘আমি পরী রাজ্যের রাজকন্যা।’ ‘ধুর! পরী না ছাই। গুল মারছো আমার সাথে।’ ‘আমি সত্য সত্যই পরী।’ ‘শুনেছি পরীদের নাকি অনেক ক্ষমতা থাকে। তুমি পারবে আমাকে আমার সমস্যা থেকে উদ্ধারে সাহায্য করতে?’ ‘হ্যঁা পারব।’ ‘তুমি আমার সমস্যাটা কি জানো?’ ‘জানি।’ এবার লিমন সত্য সত্যই বেশ অবাক হয়ে গেল। ‘তাহলে দাও না আমার সমস্যা থেকে উদ্ধার করে!’ লিমনের কণ্ঠে আবদারের সুর। হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে লিমন প্রশ্ন করল, ‘আমাকে তোমাদের দেশে বেড়াতে নিয়ে যাবে?’ ‘আমাদের দেশে তো কোনো মানুষ নেই। তুমি একা কীভাবে থাকবে?’ ‘সে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি ঠিকই থাকতে পারব।’ পরী কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিল। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে চল। তবে আমি যেটা বলব সেটা অবশ্যই মেনে চলতে হবে।’ ‘ঠিক আছে।’ লিমন সানন্দে রাজি হয়ে গেল। লিমনের কেমন যেন ঘোরলাগা অনুভ‚তি হতে লাগল। চারদিকে কেমন যেন শান্ত-স্নিগ্ধ একটা ভাব। বেশ শীত শীতও লাগছে। লিমন পরীকে প্রশ্ন করতেও সাহস পা‘েছ না যে ওরা এখন কোথায় আছে। কারণ পরী ওকে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে থাকতে বলেছে। কথা বলা ও নড়াচড়া করা একদম বারণ। কিন্তু কতক্ষণ আর চুপ করে থাকা যায়! লিমনের ভেতরটা কথা বলার জন্য ছটফট করছে। একসময় ও প্রশ্ন করে বসল, ‘আ‘ছা এখন কোথায় আছি আমরা?’ ‘আমরা পরীদের দেশে যা‘িছ।’ ‘না....না....আমি তা বলছি না। এখন আমাদের অবস্থানটা ঠিক কোথায়?’ ‘আমরা এখন মেঘের দেশে আছি।’ ‘মেঘের দেশ! সেটা আবার কোথায়?’ ‘এটা মাটি থেকে অনেক...অনেক উপরে। এখানে শুধু মেঘ আর মেঘ। সাদা মেঘ, কালো মেঘ, হালকা মেঘ, ভারী মেঘ সবই এখানে ভেসে বেড়ায়।’ লিমন এবার মনের কথাটি প্রকাশ করল। ‘আমি কি একটু চোখ খুলে দেখতে পারি? বেশিক্ষণ দেখব না। একটু দেখেই আবার চোখ বুজে ফেলব।’ পরী তীক্ষè চোখে তাকালো লিমনের দিকে। ভারী মায়াবী চেহারা ছেলেটার। না করতে খুব কষ্ট হলো পরীর। তাই অনুমতি দিতে মনস্থির করল। ‘ঠিক আছে চোখ খুলে দেখ। ভয় পেয়ো না যেন আবার!’ ‘আমি একদমই ভয় পাব না।’ খুশিতে ওর বুকটা ভরে উঠল। চোখ খুলে লিমন পুরোপুরি হতবাক হয়ে গেল। এ কোথায় চলে এসেছে সে! চারদিকে বাহারি রকমের মেঘ উড়ে যাচ্ছে ওর গা ছুঁয়ে। ও একটি মেঘকে হাত দিয়ে আলতো স্পশর্ করল। ইশ! কেমন নরম আর ঠাÐা। চারদিকে সুনসান নীরবতা। কোথাও সামান্যতম শব্দও নেই। এখানে যদি ঘর বেঁধে থাকা যেত তাহলে মন্দ হতো না। লিমন অবশ্য জানে না এখানে থাকা যায় কিনা। পরী হয়তো জানতে পারে। তাই পরীকে জিজ্ঞেস করল, ‘মেঘেদের দেশে ঘর বেঁধে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই?’ ‘পাগল নাকি তুমি? এই ঠাÐার দেশে তুমি থাকবে কী করে? আর বঁাচবেই বা কী খেয়ে?’ ‘তাইতো....আচ্ছা বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এলে হয় না?’ বাড়ির কথা মনে হতেই লিমনের আব্বু-আম্মুর কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল নিজের পোষা বিড়াল মিনির কথা; আর সবচেয়ে প্রিয় শিমুলগাছটির কথাও। লিমন ওদের ছেড়ে কিছুতেই এই অচেনা মেঘেদের দেশে থাকতে পারবে না। ওর আম্মু যতই বকাবকি করুন না কেন তার সবই ওর ভালোর জন্যই। আর আব্বু তো ওকে পাগলের মতো ভালোবাসেন। লিমনের বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল। বহুক্ষণ হলো ও বাড়ি ছেড়েছে। এতক্ষণ হয়তো আব্বু-আম্মু ওকে না পেয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছেন। লিমন পরীর কাছে আবদার জানালো, ‘আমাকে আমার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে এসো। আমি আব্বু-আম্মুর কাছে ফিরে যাব।’ ‘কেন কান্না পাচ্ছে খুব? পরীদের দেশে ঘুরতে যাবে না?’ পরী হাসতে হাসতে বলল। লিমন কোনো জবাব দিল না। ওর সত্যি সত্যিই কান্না পাচ্ছে; ভীষণ কান্না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে